রবীন্দ্রনাথ এখানে চাষাবাদ করতে এসেছিলেন : ইকবাল খোরশেদ

03 Jun 2025, 01:56 PM প্রবন্ধ শেয়ার:
রবীন্দ্রনাথ এখানে চাষাবাদ করতে এসেছিলেন : ইকবাল খোরশেদ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১]-কে আমরা জানি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, গীতিকার, চিত্রশিল্পী হিসেবে। কৃষিবিদ রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে প্রায় অচেনাই রয়ে গেছেন। ‘বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতার কবি। জমিদার হয়েও তিনি গরিব কৃষকদের দুঃখ-বেদনা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন।’ তাঁর ভাবনার একটা বড়ো অংশজুড়ে ছিল কৃষিপদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং গরিব কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন। বাংলাদেশের আধুনিক চাষাবাদের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। তিনি নিবিড়ভাবে অনুধাবন করেন যে, কৃষক বাঁচলেই গ্রাম বাঁচবে। আর তাহলেই ‘গ্রামগুলো বেঁচে উঠবে এবং সমস্ত দেশকে বাঁচাবে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর [১৭৯৪-১৮৪৬] ছিলেন সে-যুগের একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি ভারতবর্ষে শিল্প প্রতিষ্ঠা ও ব্যাংক-বিমার ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ-সম্পদ অর্জন করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ ও উড়িশ্যায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ববঙ্গে এই জমিদারির আওতায় ছিল নদীয়া [বর্তমান কুষ্টিয়া] জেলার বিরাহিমপুর [সদর শিলাইদহ], পাবনা জেলার সাহজাদপুর পরগনা [বর্তমান সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত] এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনা, পতিসর [বর্তমান নওগাঁ জেলা]। যদিও অল্পকালেই বৈশি^ক মন্দার কারণে তিনি বিপুল দেনা রেখে লন্ডনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮১৭-১৯০৫] কঠোর কৃচ্ছ্র পালন করে পিতা দ্বারকানাথের সম্পদ নিলামে তুলে এবং জমিদারির আয় থেকে ধীরে ধীরে প্রায় ৪০ বছরে সব দেনা পরিশোধ করেন।

১৮৯০ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তরুণ রবীন্দ্রনাথকে প্রথমে শিলাইদহের সেরেস্তার দায়িত্ব দেন। রবীন্দ্রনাথের কাজ ছিল দিন শেষে আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখা এবং প্রয়োজনীয় নোট লিখে রাখা এবং সপ্তাহের শেষে পিতা দেবেন্দ্রনাথকে সব বিষয়ে অবহিত করা। এভাবে পাঁচ বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর দেবেন্দ্রনাথ জমিদারির সম্পূর্ণ ভার রবীন্দ্রনাথের ওপর অর্পণ করেন।

১৮৯৫ সালের ৮ আগস্ট জমিদারির দায়িত্ব পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বজরায় করে বহুবার উন্মত্ত পদ্মা পাড়ি দেন। পূর্ব-বাংলায় এসে সাহিত্য ও কৃষিখামার- উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ঘরে তোলেন সোনালি ফসল। এদেশের জল-হাওয়া, জনসাধারণ ও তাঁদের যাপিত জীবন সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেমন ছিল রবীন্দ্রাথের অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস, তেমনি গ্রাম-উন্নয়ন, সমবায়, দারিদ্র্য-বিমোচন, প্রান্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংগঠনিক চেতনা- সব বিষয়েরই উর্বর ভূমি ছিল এই বাংলা।

জমিদারি দেখাশোনা করতে এসে ঋষিকবি একদিকে যেমন পদ্মাতীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন, অন্যদিকে তেমনি কৃষকদের হতদরিদ্র অবস্থা দেখে হন বেদনাহত, বিমর্ষ। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে একবার কবি উল্লেখ করেন, “আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট-পরিচয় হয়েছে। তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ দেখাশোনা- ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে। আমি জানি, ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে,..” রবীন্দ্রনাথ পূর্ব-বাংলার অসহায় কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। তাদের অধিকার নিয়ে, আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখান।

রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই তাঁর জমিদারিতে শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। সে-কালে জমিদারি প্রথা অনুযায়ী প্রতিবছর পুণ্যাহ-উৎসব হতো। [পুণ্যাহ হলো জমিদারদের নতুন বছরের খাজনা আদায়ের সূচনা-উৎসব] প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকে পুণ্যাহ-উৎসবে জমিদার বসতেন মখমলের সিংহাসনে, হিন্দু প্রজারা বসতেন সতরঞ্জির ওপরে বিছানো চাদরে। ব্রাহ্মণ, জমিদারির উচ্চপর্যায়ের কর্মচারী ও নায়েবেরা বসতেন তাঁদের থেকে উঁচু আসনে আর মুসলিম প্রজাদের স্থান হতো শুধু শতরঞ্জিতে। রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণিবৈষম্য ভেঙে দিতে সচেষ্ট হন। তাঁর কথা হলো পুণ্যাহ হলো মিলনোৎসব, তাই সব প্রজার এককাতারে বসার অধিকার রয়েছে। সদর নায়েব কিছুতেই প্রচলিত প্রথা ভাঙতে সম্মত হচ্ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথও জেদ ধরেন, তাহলে পুণ্যাহ-উৎসবই হবে না। শেষ পর্যন্ত কবিই জয় লাভ করেন। নতুন এই আসন-ব্যবস্থায় সাধারণ প্রজারা খুশি হলেও নায়েব, গোমস্তা, মহাজনেরা খুশি হননি। রবীন্দ্রনাথও বুঝে নিয়েছিলেন, কাদের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়াই করতে হবে। প্রথম ভাষণেই তাই তিনি বলেন, “সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে, এটাই আমার প্রথম কাজ।” ‘সাহা’ বলতে কবি ধনী হিন্দু মহাজনশ্রেণি আর ‘শেখ’ বলতে দরিদ্র মুসলিম প্রজাদের বুঝিয়েছেন।

এখন থেকে ১৩৫ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন যে, ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া প্রান্তিক মানুষ কোনোভাবেই এগিয়ে যেতে পারবে না। আর সেই জন্যই তিনি কৃষিসমবায়, যান্ত্রিককৃষি, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চাষের প্রবর্তন করেন।

কৃষকেরা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যায়। কৃষকদের চাষের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে তিনি পতিসর ও শ্রীনিকেতনে কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। উপমহাদেশে সেটিই ছিল প্রথম কৃষিব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের মূলধন তিনি সংগ্রহ করেন তাঁর ধনী বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই ব্যাঙ্কে ঠাকুরপরিবারের অনেক সদস্য, আত্মীয়স্বজন টাকা জমা রাখেন। এই ব্যাঙ্ক থেকে কৃষক শতকরা তিন টাকা হার সুদে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করে। ফসল ওঠার পর সুদসহ ঋণের টাকা পরিশোধ ক’রে পরবর্তীসময়ে আবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে চাষিরা মহাজনের চক্রবৃদ্ধি হারে সর্বনাশা সুদের কবল থেকে রক্ষা পায়। ১৯১৩ সালে সেই ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা থেকে ৭৫ হাজার টাকা ব্যাঙ্কে বিনিয়োগ করেন। যতদূর জানা যায়, ব্যাঙ্কে বিনিয়োগকৃত টাকা রবীন্দ্রনাথ ফেরত নিতে পারেননি। অবশ্য এর জন্য তাঁর কোনো আফসোসও ছিল না।

কৃষিকাজকে বেগবান করতে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথ, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র্র মজুমদার এবং এক বছর পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিশিক্ষার জন্য পাঠান। তাঁদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে তাঁকে স্ত্রীর গয়না, পুরীর বাড়ি বিক্রি করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে না পাঠিয়ে বাংলার মুসলমান কৃষকদের জীবনমান উন্নত করতে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন কৃষি শিখতে। তাঁরা যে এদেশের দরিদ্র কৃষকের খাজনার টাকায় বিদেশে পড়াশোনা করছে এবং ফিরে এসে এদের প্রতি যে তাঁদের কিছু কর্তব্য রয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দিতে ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত এই তিনজনকে এক চিঠিতে লেখেন, “তোমরাও দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের অনুগ্রহের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ, ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণে যদি বাড়িয়ে দিতে পারো তাহলে এই ক্ষতি পূরণ হয়ে মনে সান্ত¡না পাব। মনে রেখ এই টাকা চাষীর, এই চাষীরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধাপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে- এদের এই অংশ সম্পূর্ণ শোধ করার দায় তোমাদের উপর রইল।”

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন, নতুন ফসল চাষের প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। তাই নিজের জমিদারিতে তিনি নতুন জাতের ধানচাষ, পাটনাই মটরসহ নানান অর্থকরী শস্যের চাষ করতে শুরু করেন। এছাড়াও ধান ও পাটের ওপর নির্ভরশীল না-থেকে মাছচাষ, আলুর চাষ, খেতের আলে কলা, আনারস চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করেন। ১৯০৮ সালে এক কর্মীকে কবি চিঠিতে লেখেন, “প্রজাদের বাস্তুবাড়ি, খেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদের উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাইর হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল, আঙ্গুর গাছ, বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাইর করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে।’

১৯০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৮৮-১০৬১]। দেশে ফিরেই তিনি শুরু করেন পতিসরের মাটিতে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ। রবীন্দ্রনাথ বিদেশ থেকে ট্রাক্টর আমদানি করেন। পতিসরের মাটিতেই প্রথম ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদ শুরু হয়। ট্রাক্টর চালান রথীন্দ্রনাথ নিজে। ট্রাক্টর দেখার জন্য হাজার হাজার লোক ভীড় করে। ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদে কৃষকেরা হয় মহাখুশি।

রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র কৃষকদের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করে তুলতে বহুমুখী কৃষিকাজ প্রবর্তনের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে অকৃষিখাত যেমন, কুটিরশিল্প, রেশমশিল্প ও তাঁতশিল্পের সম্প্রসারণসহ আয়যোগ্য কর্মসূচি গ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি কুষ্টিয়ায় বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারির প্রজাদের সার্বিক উন্নতির কথাই বরাবর ভেবেছেন। তিনি ১৯০৭ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসভার প্রাদেশিক সম্মেলনে ১৫ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। কবির ১৫ দফার মধ্যে ছিল আধুনিক কৃষি, কুটিরশিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাঙ্ক-সহ নানান কর্মক-ের এক সমবায়ভিত্তিক রূপরেখা। তাঁর সমবায়ের কাজে যুক্ত হন সমাজকর্মী কালীমোহন ঘোষ। পরে যুক্ত হন বিপ্লবী অতুল সেন। অতুল সেনই কৃষিব্যাঙ্কের দায়িত্ব পালন করেন। কৃষিব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় এবং প্রজাদের খাজনার সঙ্গে টাকাপ্রতি এক আনা অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে পতিসর, কমতা ও রাতোয়ালে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় দরিদ্র কৃষকদের চিকিৎসার জন্য। একবার কালীগ্রামে মহামারিরূপে ওলাওঠা [কলেরা] দেখা দেয়। এই মরণব্যাধি থেকে প্রজাদের রক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ অতুল সেনকে চিঠিতে লেখেন, “আমি কয়েকটি ওলাওঠার ওষুধের বাক্স পাঠাইতেছি এবং যদি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার পাঠাইতে পারি, সেটা দেখবে।”

রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, পতিসর ও শ্রীনিকেতনে পৌষমেলা, মাঘোৎসবসহ ঋতুভিত্তিক নানা অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করতেন। ১৯২৮ সালে শ্রীনিকেতনে ‘হলকর্ষণ’ নামে একটি উৎসবের আয়োজন করেন। হলকর্ষণ মানে জমি চাষের উৎসব। উৎসবে তিনি বলেন, “আজকার অনুষ্ঠান পৃথিবীর সঙ্গে হিসাব-নিকাশের উপলক্ষে নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবার, পৃথিবীর অন্নসত্রে [নিরন্ন, উপবাসী] একত্র হবার যে বিদ্যা, মানবসভ্যতার মূলমন্ত্র যার মধ্যে, সেই কৃষিবিদ্যার প্রথম উদ্ভাবনের আনন্দস্মৃতিরূপে গ্রহণ করব এই অনুষ্ঠানকে।” এইসব উৎসবে বিভিন্ন গান গীত হয়। রবীন্দ্রনাথের লেখা সে-সব গানেও কৃষি ও ফসলের কথাই উঠে আসে বারংবার। যেমন:

“আমরা চাষ করি আনন্দে।

মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে ॥

রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,

বাতাস ওঠে ভ’রে ভ’রে চষা মাটির গন্ধে ॥”

ফসল কাটার উৎসবে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কবি রচনা করেন :

“আয় রে মোরা ফসল কাটি

বাদল এসে রচেছিল ছায়ার মায়াঘর,

রোদ এসেছে সোনার জাদুকর-

মোরা নেব তারি দান, তাই-যে কাটি ধান,

ও সে সোনার জাদুকর”

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রতিটি গ্রামের স্বনির্ভরতার মধ্যেই নিহিত আছে এদেশের গ্রামীণসমাজের উন্নতি। ‘পল্লী প্রকৃতি’ পুস্তিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “শিলাইদহ, পতিসর এইসব পল্লীতে যখন বাস করতুম তখন আমি প্রথম পল্লী জীবন প্রত্যক্ষ করি। প্রজারা আমার কাছে তাদের সুখ, দুঃখ, নালিশ, আব্দার নিয়ে আসতো। তার ভিতরটি দিয়ে পল্লীর ছবি আমি দেখেছি। একদিকে বাইরের ছবি নদী, প্রান্তর, ধানক্ষেত, ছায়াতরুর তলে তাদের কুটির- আর একদিকে তাদের অন্তরের কথা। তাদের বেদনাও আমার কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পৌঁছত।”

রবীন্দ্রনাথ এদেশের দরিদ্র কৃষকদের হৃদয় দিয়ে ভলোবেসেছিলেন। প্রজারাও তাঁকে ভালোবাসতো একান্ত আপনার লোক হিসেবে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন তিনি ১৯৩৭ সালে শেষবারের মতো পতিসরে আসেন পুণ্যাহ-উৎসবে। সে-বছর প্রজাদের পক্ষ থেকে তাঁকে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনায় তাঁরা কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন এই বলে যে, “প্রভুরূপে হেথা আস নাই, তুমি দেবরূপে এসে দিলে দেখা। দেবতার দান অক্ষয় হউক। হৃদিপটে থাক স্মৃতিরেখা।” অভিভূত রবীন্দ্রনাথ এর জবাবে বলেন, তোমাদের কাছে অনেক পেয়েছি কিন্তু কিছু দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না।... তোমাদের সবার উন্নতি হউক- এই কামনা নিয়ে আমি পরলোকে চলে যাব।”

এর তিন বছর পর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কবির মৃত্যু হয়।