বিয়ে প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি বিশেষ মুহূর্ত। এটি কেবল দু’টি মানুষের নয়, বরং দু’টি পরিবারের একত্রীকরণের উৎসবমুখর উদ্যাপন। বাঙালি সংস্কৃতিতে বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই বিভিন্ন রীতিনীতি, আনন্দ-উল্লাস, সাজসজ্জা এবং ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সমন্বয়। বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠান শুধু একটি সামাজিক বা ধর্মীয় রীতি নয় ; এটি আবেগ, ভালোবাসা এবং সম্পর্কেও গভীরতার উদ্যাপন। প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে আজকের বিয়ের অনুষ্ঠান আরো রঙিন এবং প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এটি এমন এক মঞ্চ, যেখানে ভালোবাসা এবং বন্ধন উদ্যাপিত হয় সবার সঙ্গে।
আমাদের সংস্কৃতিতে কয়েক দশক আগেও বর কনে বাছাই করার প্রক্রিয়াটি পরিবারের বড়োরাই করতো। তবে এই প্রবণতা এখন একটা প্রকট নয়, একালের তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের পচ্ছন্দকেই অগ্রধিকার দেয়।
একটি পরিপূর্ণ বিয়ের উৎসবগুলো একসাথে বর্ণনা করাটা একটি কষ্টসাধ্য বটে। তবুও বিযের এই সিজনে বিয়ে নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করা যেতেই পারে।
পানচিনি
আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন জুটির বন্ধন চূড়ান্ত হয় এই অনুষ্ঠানে। গ্রাম বাংলায় বা প্রাচীন বাংলায় যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে অতিথিদেরকে পান সুপুরি দিয়ে অভ্যর্থনা করা ছিল একটি রীতি। ‘পান’ যখন রুপালি রাংতায় মুড়ে পরিবেশন করা হয় তখন তা কোনো বিশেষ উৎসবের শুভ বার্তা বহন করে। এই জাতীয় অনুষ্ঠানে মিষ্টি আনাও অতি প্রচলিত ও আবশ্যিক অংশ। পানচিনি নামটি এসকল পরিবেশন থেকেই হয়েছিল।
আইবুড়ো ভাত
এটি বিবাহিত জীবনে প্রবেশের আগে নিজের ঘরে আয়োজনের মাধ্যমে উপভোগ করা শেষ খাবারটিকে বোঝায়। এই ঘরোয়া ভোজ উৎসবের জন্য আহ্বান জানানো হয় কনের বিস্তৃত পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের। আমন্ত্রিতরা উদ্যাপনে যোগ দেয় এবং কনেকে শুভকামনা জানায়। ‘আই বুড়ো ভাত’ ভোজের মধ্যে সাধারণত বাঙালি খাবার যেমন ভাত, মাছ, লুচি, শাকসব্জি, তরকারী এবং মিষ্টিজাতীয় খাবারের ভেতরে বিভিন্ন পিঠাপুলি। এছাড়াও অন্যান্য জনপ্রিয় ও কনের প্রিয় খাবার থাকে।
গায়ে হলুদ
এটি কনে এবং বর উভয়ের জন্য প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠান। অতীতে এটি একটি পারিবারিক বিষয় ছিল যেখানে মহিলারা অংশ নিত এবং পুরুষদের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অনুমতি মিলতো না।
বিবাহ-পূর্ব বিউটিফিকেশন অনুষ্ঠান হিসেবে নববধূ হলুদ এবং অন্যান্য সুগন্ধযুক্ত বিভিন্ন হার্বাল পণ্য দিয়ে চর্চিত হন। প্রচলিত রীতিতে কনের হলুদ অনুষ্ঠান বরের গায়ে হলুদের আগের দিন হয়ে থাকে।
উপহার এবং মিষ্টান্ন সম্মৃদ্ধ ডালা কুলা ইত্যাদি উপঢৌকন এই দিনে নেওয়া হয়। সেগুলি মোড়ানো এবং সাজানো হয় সুন্দর ও নান্দনিক শৈলীতে যা বিবাহের থিম ও একেক পরিবারের রুচী, নান্দনিকতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বিবৃতি দেয়। পুরো আয়োজনটিই অতি চমৎকার।
এই অনুষ্ঠানের মূল ঐতিহ্য হলো হবু বর বা বধুর পাশে বসে পরিবার ও বন্ধুরা তার কপালে হলুদের ছোঁয়া ও সুবাসের প্রলেপ দিয়ে দেয়, ঠিক যেন এক স্নেহচুম্বন। হবু বর বা বধূর সামনে সুসজ্জিত থাকে সুস্বাদু মুখোরোচক সব খাদ্যের ভা-ার। এর থেকে তাদের অনুমতি বা পছন্দ সাপেক্ষে কোনো খাবার সামান্য মুখে তুলে দেওয়া হয়।
হেনা উৎসব
এটি এমন একটি অনুষ্ঠান, যাতে কনের হাত মেহেদির মাধ্যমে নান্দনিক ডিজাইন দিয়ে রাঙানো হয়। এমনও বলা হয় যে, মেহেন্দির রং যত গভীর হয়, কনের প্রতি বরের ভালোবাসা ততই দৃঢ় হয়। একমাত্র এটিই শুধুমাত্র মেয়েদেরই অনুষ্ঠান যেখানে সংগীত এবং নৃত্যের আয়োজন রয়েছে এবং নারী আত্মীয়া বন্ধুরা আনন্দময় মুহূর্তটি উদ্যাপন করতে মেহেদি পরেন। কথিত ছিল যে কনে যখন বরের বাড়িতে যায় তখন তার মেহেদির রং বিবর্ণ না হওয়া অবধি তার কাছে বাড়ির কোনো কাজ করার আশা করা হয় না।
বিয়ে
বিয়ে প্রচলিতভাবেই একটি বহুল ব্যয়সাদ্ধ কিন্তু অতি পুলকময় এক ঘটনা। পুষ্পশোভিত অলঙ্করণ, মঞ্চের জন্য বিস্তৃত অঙ্গসজ্জা এবং বসার জায়গাÑ সবই অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরিবেশটি চিরন্তন মহিমাকেই যুগ কাল পেড়িয়ে প্রতিধ্বনিত করে। জনপ্রিয় থিমগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো রেগুলার বা বারোয়ারি, ক্লাসিক, আধুনিক, সুপ্রাচীন এবং বহিরাঙ্গন।
পরিবেশটি হয় মনোমুগ্ধকর এবং আনন্দদায়ক। ‘রুসমত’ অনুষ্ঠানটি বড়োসংখ্যক শ্রোতার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। বর এবং কনেকে এসময়ে কিছুক্ষণের জন্য একই পর্দার নিচে রাখা হয় এবং বরকে তার ও কনের মাঝখানে ধরা আয়নায় কনেকে প্রথম দৃষ্টিতে দেখে তার অনুভূতির প্রেমময় প্রকাশ করতে হয়।
কনের ছোটো ভাইবোন কাজিন এবং বন্ধুরা বিয়ের হলের প্রবেশদ্বারেও প্রবেশের অর্থ দাবি করে বরকে গেটে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করে। এমনকি বরের জুতা লুকিয়েও চাঁদা আদায়ের লক্ষ্যে থাকে। এসবই দুই পক্ষের কাছে স্বীকৃত নির্দোষ মজা ছাড়া অন্যকিছু নয়। এসবের মাধ্যমে ছোটো ভাইবোনেরা তাদের মোটা পকেটমানি পেয়ে খুবই উল্লসিত থাকে।
বউভাত
এটি নবদম্পতিতে সম্মান জানাতে এবং তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বরের পরিবার কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানেই অনেকে প্রথমবারের জন্য কনের সাথে দেখা করে। এই অনুষ্ঠান কনের পরিবারের আয়োজিত বিয়ের দিনের আতিথেয়তার জন্য বরের পরিবারের পক্ষ থেকে পাল্টা আতিথিয়তার সুযোগ।
অতিথিদের জন্য বিবাহ এবং ‘বউ ভাত’ উভয় সময়ে উপহার প্রদান করা সাধারণ রীতি। তবে এই অনুষ্ঠানের এই নামকরণের ইতিহাস হলো, অতীতে এটি ছিল একটি ভোজ যাতে কনে তার শ্বশুরবাড়িতে নিজ হাতে প্রথম রান্না করতেন তার নতুন পরিবার এবং তার বাপের বাড়ির নিকটতম সদস্যদের জন্য ।
ফিরানী : বিয়ের পর স্বামীসহ বাবার বাড়ি
প্রচলিত রীতিতে বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে বর বউকে নিয়ে কনের বাড়ির সবাই কনের বাড়িতে ফিরে আসেন। নতুন পরিবারে বউয়ের অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে উন্মুখ ভাইবোন আত্মীয়দের ঘিরে হাসি আনন্দমুখর দুই থেকে তিনদিন নতুন কনে বাবার বাড়িতে বরকে নিয়ে কাটান। জামাই আদরের প্রথম ঘরোয়া এই সুযোগে কনের আত্মীয়রাও বরের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার চমৎকার সুযোগ পায়।
লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন