চোখ দিয়ে আমরা এই পৃথিবীর সবকিছু দেখতে পাই। প্রত্যহিক জীবনে আমরা ঘুম থেকে উঠি, চোখ খুলে তাকাই এবং বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করি। একবার কল্পনা করুন তো যদি এই দু’চোখ দিয়ে দেখতে না পেতেন তবে জীবন কত না দুর্বিষহ হতো ! তাই সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে দৈনন্দিন যেকোনো কাজের প্রথম শর্ত হলো পরিষ্কারভাবে চোখে দেখতে পাওয়া। আমাদের এই পরিষ্কার দেখার একটি বাধা হতে পারে চোখের ‘ছানি’ বা ‘ক্যাটারেক্ট’। ছানি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কাটরাকটেস’ থেকে যা শিথিলভাবে জল প্রপাতকে অনুবাদ করে। এটি বিশ্বাস করা হয়েছিল যে, মস্তিষ্ক থেকে একটি জমাট তরল চোখের লেন্সে প্রবাহিত হয়েছিল। পরবর্তীসময়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন কেন এবং কীভাবে এই ছানি পড়ছে আর এর প্রতিকার কী ?
ছানি বা ক্যাটারেক্ট [catract] আসলে কী
আমাদের চোখে আলো পড়লে তা চোখের বিভিন্ন স্বচ্ছ মাধ্যম ভেদ করে চোখের রেটিনা বা দৃষ্টি সংবেদনশীল অংশে পড়লে আমরা দেখতে পাই। আলো যেসব স্বচ্ছ মাধ্যম অতিক্রম করে তা হলো যথাক্রমে : কর্নিয়া, অ্যাকুয়াস হিউমার, লেন্স ও ভিট্রিয়াস হিউমার। এখন চোখের এই চারটি স্বচ্ছ অংশের যেকোনো একটি অস্বচ্ছ হলেই আমাদের দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটবে। সবচেয়ে বেশি যে অংশটি অস্বচ্ছ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা হলো ‘লেন্স’; আর লেন্স অস্বচ্ছ হলেই তাকে আমরা ছানি বলে থাকি। আমাদের চোখের গঠন এতটাই জটিল যে, সেটা মাঝে মাঝে আমাদের কল্পনাশক্তিকেও হার মানায়। চোখের কার্যপদ্ধতি অনেকটা ক্যামেরার মতোই। চোখের পাতা কাজ করে ক্যামেরার শাটারের মতো, চোখের ভেতরে আছে স্থিতিস্থাপক লেন্স যা দর্শনীয় বস্তুকে ফোকাস করে এবং প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে একসময় তা আমরা দেখতে পাই।
চোখে ছানি পড়ার কারণ
চোখে ছানি বা লেন্স অস্বচ্ছ হওয়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম এবং সাধারণ কারণ হলো ‘বয়স’। সাধারণত চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকেই চোখে ছানি পড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটি অনেকটা বার্ধক্যে যাওয়ার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। বয়সজনিত কারণ ছাড়া অন্যান্য যেসব কারণে চোখে ছানি পড়তে পারে সেগুলো হলো-
চোখে আঘাত লাগা : চোখে আঘাত লেগে অনেকের রাতারাতি ছানি পড়তে পারে। বিশেষ করে যারা বাইরে খেলাধুলা করে। যেমন টেনিস বলের সরাসরি চোখে আঘাতে ছানি পড়তে পারে। এরকম আঘাত থেকে বাঁচতে হেলমেট বা protectire equipment পরে খেলতে হবে।
অতিবেগুনি রশ্মি/সূর্যালোকের দীর্ঘ এক্সপোজার : এটিও একটি অন্যতম প্রধান কারণ চোখে ছানি পড়ার। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মানব ত্বকে অনেকরকম ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ, এটা আমরা অনেকে জানলেও ছানির যে অন্যতম একটা প্রধান কারণ এই বিকিরণ তা আমরা অনেকেই জানি না। রোদচশমার ব্যবহারে এ থেকে আমরা উপকার পেতে পারি।
দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস : বলা হয়ে থাকে ডায়াবেটিস হলো সকল রোগের দরজা। তেমনিভাবে ডায়াবেটিস চোখেরও বিভিন্ন রোগের কারণ ; যেমন ছানি, চোখের ভেতরে রেটিনায় রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস চোখের ছানির প্রক্রিয়াকে অনেক ত্বরান্বিত করতে পারে। রক্তে অতিরিক্ত শর্করা বা চিনি চোখের লেন্সে জমা হয়ে লেন্সকে ঘোলা করে দেয় এবং এভাবে অতিরিক্ত ডায়াবেটিসজনিত কারণে চোখে ছানি পড়ে।
দীর্ঘদিন যাবৎ স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধের ব্যবহার : দীর্ঘদিন যাবৎ স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধের ব্যবহারের ফলেও চোখে ছানি পড়তে পারে। এছাড়াও ছানি হওয়ার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বংশগত, ধূমপান ও অ্যালকোহলে আসক্তি, বিভিন্ন ভিটামিনের ঘাটতি অথবা চোখের বিভিন্ন ইনফেকশন।
চোখে ছানির লক্ষণ
চোখের ছানির বেশ কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। যেমন : * মেঘলা/দুগ্ধ/কুয়াশা/অস্পষ্ট দৃষ্টি, * রাতেরবেলায় দুর্বল দৃষ্টি, * পাঠের জন্য উজ্জ্বল আলোর প্রয়োজন, * আলোর চারপাশে একটি হ্যালো [halo] দেখা বিশেষ করে রাতে হেডলাইটের দিকে তাকালে, * রং বিবর্ণ দেখতে পাওয়া, * সূর্যালোক এবং উজ্জ্বল আলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান সংবেদনশীলতা, * চশমার জন্য ঘন ঘন প্রেসক্রিপশন পরিবর্তন করা, * চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করেও স্পষ্ট দেখতে না পাওয়া।
ছানির চিকিৎসা
চোখের ছানির একমাত্র চিকিৎসা অপারেশনের মাধ্যমে চোখের প্রাকৃতিক ঘোলা লেন্স বা ছানি সরিয়ে কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন। ছানি অপারেশনের ক্ষেত্রে প্রথমে তিনটি জিনিস দেখা হয়, তা হলো- ছানি টি ইম্ম্যাচিউর, ম্যাচিউর, নাকি হাইপারম্যাচিউর। ছানি ম্যাচিউর অবস্থায় অপারেশন করতে হবে, ইম্ম্যাচিউর বা হাইপারম্যাচিউর অবস্থায় করা যাবে না। হাইপারম্যাচিউর অর্থাৎ ছানি বেশি পেকে গেলে তা বিভিন্ন অসুবিধার সৃষ্টি করে। যেমন : চোখের প্রেশার বেড়ে যাওয়া, চোখকে ভেতর থেকে চাপ দিয়ে বিভিন্ন অংশের জোড়া লেগে যাওয়া ইত্যাদি। তাছাড়া হাইপারম্যাচিউর ক্যাটারেক্ট বা অতি পাকা ছানি অপারেশন-পরবর্তী জটিলতাও বেশি হয়ে থাকে। সুতরাং চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছানি অপারেশন করতে বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেরি না করে অপারেশন করে ফেলতে হবে।
ছানি অপারেশনের বিভিন্ন পদ্ধতি
বর্তমানে ছানি অপারেশনের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দু’টি পদ্ধতি হলোÑ ‘ফ্যাকো’ [phacoemulsification pacho] ও ‘এসআইসিএস’ [sics- small gnision cataract surgery]। এই দুটো পদ্ধতির মধ্যে ফ্যাকো বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এখানে ছোটো একটি ছিদ্র দিয়ে চোখের ভেতরে মেশিন ঢুকিয়ে ছানি গলিয়ে ফেলা হয় ও মেশিনের সাহায্যে পরিষ্কার করা হয় এবং কৃত্রিম লেন্স স্থাপন করা হয়।
চোখে ছানির সর্বাধুনিক সার্জারি লেজার ফ্যাকো সার্জারি। অত্যন্ত ব্যয়বহুল ফেমটো লেজারের সাহায্যে এই সার্জারি করা হয়। চোখকে ফেমটো লেজার মেশিনের সঙ্গে সংযুক্ত করে লেজার রশ্মি দিয়ে চোখের ছানির ওপরের অংশ গোল করে নিখুঁতভাবে কেটে ছানিকে ৮ বা ১৬ টুকরো করা হয়। এই চিকিৎসা প্রচলিত ফ্যাকো সার্জারির চেয়েও সঠিক ও গুণগতমানও অনেক ভালো।
কৃত্রিম লেন্স কত প্রকার
প্রাকৃতিক লেন্স সরিয়ে কৃত্রিম কোনো লেন্স দেওয়া হবে তা নির্ভর করে চক্ষু সার্জন ও রোগীর ইচ্ছার ভিত্তিতে। বিভিন্ন প্রকারের কৃত্রিম লেন্সের মধ্যে কিছু আছে যা দিলে পরবর্তীসময়ে দূরে বা কাছে দেখার জন্য কোনো চশমার প্রয়োজন হয় না। আবার কিছু লেন্স আছে যা দিয়ে অপারেশন-পরবর্তী দূরে চশমা না লাগলেও কাছে বই পড়ার জন্য চশমার দরকার হতে পারে।
ছানির প্রতিকার
ছানি একেবারে প্রতিহত করার মতো কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে, কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে আমরা ছানি প্রক্রিয়ার অগ্রগতিকে কমিয়ে কিছুটা দেরি করাতে পারি, এর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম নিয়ম হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা ও প্রতিবছর অন্তত একবার চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে চোখ দেখিয়ে পরামর্শ নেওয়া। এছাড়া সতেজ শাকসবজিও চোখ ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সবশেষে বলতে চাই, শুধু বড়োদের নয়, শিশুদের এমনকি নবজাতক শিশুরও চোখে ছানি পাওয়া যেতে পারে। একে বলা হয় ‘কনজেনিটাল ক্যাটার্যাক্ট’ [congenital cataract]। এমন হলে দ্রুত চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
পরিশেষে, ছানি নিয়ে নয় আর কোনো ভয় বা ভুল ধারণা। ছানি হলে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে। কারণ, এটাই ছানির একমাত্র চিকিৎসা। কোনো ওষুধ দিয়ে ছানি ভালো হয় না। তাই ছানির লক্ষণ দেখা দিলে অতিসত্বর চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
লেখক : এমবিবিএস, এমএস [ফেইজ-বি] চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা