প্রবাদপ্রতিম নজরুলসংগীতশিল্পী শাহীন সামাদ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যে-রকমভাবে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছিলেন কণ্ঠ দিয়ে। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’য় যোগ দেন। বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্প এবং মুক্তাঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করতেন। তিনি তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। গত বছর মে মাসে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত নজরুল পুরস্কার-২০২৩ তুলে দেওয়া হয় তার হাতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত হওয়া এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আনন্দভুবনের ১৭ বর্ষ ২১ সংখ্যা [১৬ মার্চ ২০২৩] তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল পরিবারের লোকজন তো বিশ্বাসই করেন নাই আমি বেঁচে আছি। এতে তার সম্পর্কে লেখা হয় :
শাহীন সামাদ দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে ধ্রুপদী সংগীতচর্চায় নিয়োজিত আছেন। মুক্তিযোদ্ধা প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী শহীন সামাদের সংগীতে হাতেখড়ি মাত্র সাত বছর বয়সে। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় শাহীন সামাদ ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নজরুলের গানকে বাংলাদেশের সংগীতপিপাসুদের কাছে সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। তিনি খুব অল্প বয়স থেকে ওস্তাদ রাম গোপাল, ফজলুল হক, ফুল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সগীর উদ্দিন খান, মশকুর আলী খানের মতো খ্যাতিমান প-িতদের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন। এছাড়া তিনি পরবর্তীসময়ে শেখ লুৎফর রহমান, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাস, অঞ্জলি রায়, সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, আজাদ রহমানের কাছে তালিম নেন।
শিল্পী জীবনের শুরু থেকেই নিজস্ব গায়কি ঢং সৃষ্টিতে সক্ষম শাহীন সামাদ। শুধু নজরুলসংগীত নয়, পুরনো দিনের বাংলা গান পরিবেশনেও সফলতা অর্জন করেন।
লেখা : শহিদুল ইসলাম এমেল
চলতি সময়ে
স্বাধীনতার পর শাহীন সামাদ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন চলে যান। ২২ বছর ছিলেন সেখানে। তবে আসা-যাওয়া ছিল প্রতিবছরই। তিনি যে ঢাকায় নেই সেটা অনেকেই জানত না। তিনি যখন দেশে আসতেন তখন বিটিভির জন্য অনেকগুলো গান করে যেতেন। তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না। তার গানগুলো তখন একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিতে সবসময় প্রচারিত হতো। যার কারণে কেউ বুঝতে পারেনি তিনি দেশের বাইরে আছেন।
একজন নারী হয়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। অবশ্য অনেক নারীই তখন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তার বিষয়টি ছিল ভিন্ন। বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান শাহীন সামাদ। এতে তার মা-সহ পরিবারের অন্যরা কষ্ট পান। তার বাবা যুদ্ধের আগেই মারা গিয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর।
তিনি সংগীতে গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়া নজরুল ইনস্টিটিউট আজীবন সম্মাননা, ন্যাশনাল প্রেসক্লাব অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ হাইকমিশন [কলকাতা] অ্যাওয়ার্ড, বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার-২০২৩ সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
শাহীন সামাদ ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সামসুল হুদা, মাতার নাম শামসুন নাহার রহিমা খাতুন। তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলায়।
লেখা : শহিদুল ইসলাম এমেল