“নয়নে বসন্ত হৃদয়ে বসন্ত
বসন্ত এসেছে মনে
রঙের ধারায় ভরেছে ভুবন
বাতাস বইছে বনে।”
বসন্ত এসে গেছে বাংলার প্রকৃতিতে। বসন্তে মন ওঠে দুলে। বসন্তের আগমনে প্রকৃতি তার জীর্ণতা, মলিনতা মুছতে শুরু করে। গাছে গাছে আসে নতুন পাতা, ফোটে নানান ফুল। দক্ষিণ সমীরণে আন্দোলিত হয় গাছের কচিপাতা, সেই সঙ্গে মানুষের মনও। ছয়টি ঋতুর বাংলাদেশে বসন্ত বিরাজ করে ঋতুরাজ হয়ে। ঘর থেকে পা বাড়ালেই চোখের তৃষ্ণা মেটায় শিমুল, অশোক, আকন্দ, স্বর্ণলতা, কাঠচাঁপা, গুলঞ্চ, পিয়াল, কৃষ্ণচূড়া, পারুল, মাধবীলতা, মহুয়া, রক্তকরবী, নাগেশ^র, আর কত কত রং-বেরঙের ফুল। রঙিন মাখা মেলে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি। আমের বনে নতুন মঞ্জরিতে মৌমাছি, ভ্রমরের দল গুঞ্জরণ তোলে। কোকিলের কুহু তান আর গানের পাখি ‘বউ কথা কও’-এর সুমধুর সুরে মন উদাস করে দেয়। উদাসী মন ছুটে যেতে চায় প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে।
প্রকৃতির রূপ-বৈচিত্র্য অনন্য হয়ে বাঙ্গাব্দের শেষ ঋতু ফাল্গুন ও চৈত্র ধরা দেয় বসন্তকাল হয়ে। আগুন রাঙা ফাগুনের মাদকতা ছড়িয়ে যায় সবখানে, সব মানুষের মনে। সুদূর অতীত থেকে বসন্তের অপরূপ মোহনীয় রূপ আলোড়িত করেছে বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের। বসন্তবন্দনায় মেতে উঠেছেন তাঁরা। বসন্ত নিয়ে রচিত হয়েছে বহু কবিতা ও গান। আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনপর ভুলে সকলের সঙ্গে মিলে জীবন উদ্যাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন :
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
করো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয় দল খুলিয়ো
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো
এই সংগীত মুখরিত গগনে
তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।
কাজী নজরুল ইসলাম ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত’ কবিতায় বসন্তকে চঞ্চল তরুণ দুরন্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন :
এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
হেমন্তপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশও বসন্তের রাত নির্ঘুম কাটান। ‘পাখিরা’ কবিতায় কবি বলেন :
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে-
বসন্তের রাতে
বিছানায় শুয়ে আছি ;
এখন সে কত রাত !
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,
স্কাইলাইট মাথার উপর,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ কবিতা তো লোকের মুখে মুখে ফেরে :
‘ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত
শান-বাঁধানো ফুটপাতে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে।
আগুন লাগা ফাগুন মাসেই রক্ত ঝরেছিল মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আব্দুস সালাম, রফিকউদ্দিন, বরকত, জব্বার, শফিউর, ওহিউল্লাহ একসার থোকা থোকা জ¦লন্ত নাম জীবন উৎসর্গ করেছে। তাই তো কবি আসাদ চৌধুরী তাঁর ‘ফাল্গুন এলেই’ কবিতায় বসন্তের কোকিলের নাম দিয়েছেন ভাষা :
ফাগুন এলই একটি পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে ? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আশা
নাম দিয়েছি ভাষা,
কত নামেই তাকে ডাকি
মেটে না পিপাসা।
আবার এই বসন্তেই সূচনা হয়েছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের। সবদিক থেকেই বসন্ত বাঙালির জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঋতু।
কয়েক বছর আগেও বসন্ত বাংলার প্রকৃতিকে যে রং-রূপে সাজিয়ে তুলত নববধূর মতো তার অনেকটাই এখন ফ্যাকাশে বিবর্ণ। নির্বিচারে বন উজাড়, জলবায়ুর পরিবর্তন, বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইডের আধিক্য প্রভৃতি নানা কারণে বসন্তের এই হতদরিদ্র চেহারা। কারণগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করলে বসন্ত ফিরে পাবে তার রূপ-যৌবন।
লেখা : শ্যামল কায়া