`১৯৭১ : শরণার্থী-জীবন

20 Dec 2023, 03:42 PM অভোগ শেয়ার:
`১৯৭১ : শরণার্থী-জীবন

শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,

যশোর রোডের দু’ধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।

কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,

আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।

ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ,

মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।

শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,

এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূব-বাংলা কলকাতা চলে।

এটি মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। সেই সময়টাতে তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো ‘যশোর রোড’। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তিনি যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন।

সমস্ত পূর্ব-বাংলা যেন তখন পশ্চিম বাংলামুখী। সন্তানের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার আশায় একটু নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ তখন শুধু ছুটেছে সীমান্তজুড়ে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলোতে। দেশের ভেতর তখন রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। আর টিকে থাকার তাগিদে নিরীহ মানুষগুলো ছুটে চলছে সীমান্তের দিকে। পথের দূরত্ব হয়ত শত মাইল অথবা তারও বেশি। তারপরও তারা হেঁটে যাচ্ছে কাদা-মাটি পথ, অতিক্রম করছে ঘন জঙ্গল। সীমান্ত পার হওয়ার আগেই ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে হয়ত কোনো ক্লান্ত বৃদ্ধা, পথের ধকল না সইতে পেরে হয়ত মায়ের কোলেই চিরতরে ঘুম আদরের সন্তানের। হয়ত কাছেই সীমান্ত, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আরেকটু প্রবল হতেই পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছে কেউ। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘এক কিশোরীর যুদ্ধযাত্রা’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কিশোরী। বরিশাল থেকে পালিয়ে তিনি কীভাবে ভারতে পৌঁছেছেন সেটি তিনি তুলে ধরেছিলেন তার বই-এ।

‘সদ্য কিশোরী বয়সে দেশ, নিপীড়ন, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ একটু একটু করে বুঝতে বুঝতে যে-দিন দেশ ত্যাগ করি, সেদিন থেকে ফ্রকপরা আমি বড়ো হয়ে যাই।’

‘তারপর শরণার্থী দলের সাথে অবর্ণনীয় কষ্ট করে আগরতলায় রাজবাড়ি শিবিরে নাম লিখিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিই। সেখানে থাকতেই শর্টকোর্স নার্সি ট্রেনিং করে ফিল্ড হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করি।’

পশ্চিমবঙ্গ তখন আদতে হয়ে গিয়েছিল কোটি মানুষের এক পূর্ব-বাংলা। কারণ প্রায় ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সীমান্তে। সীমান্তজুড়ে শরণার্থী শিবিরগুলো হয়ে উঠেছিল একেকটি বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ নামের একেকটি ঘর। আজকের প্রজন্ম হয়ত ধারণাও করতে পারবে না কতটা অবর্ণনীয় কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ। শরণার্থী শিবির নিয়ে আজকের প্রজন্মের ধারণা খুব ভাসা ভাসা। কিন্তু তাদের জানা উচিত কীভাবে দিন কাটিয়েছে শরণার্থী শিবিরের মানুষগুলো। ঝড় বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে অনাহারে অর্ধাহারে কত কষ্টে ছিল সেখানকার মানুষগুলো।

শরণার্থীদের জীবন

পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের প্রায় ১৩৫০ মাইল সীমান্ত জুড়েই গড়ে ওঠেছিল শরণার্থী শিবিরগুলো। দলে দলে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানি আর্মির হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিচ্ছে শিবিরগুলোতে। শরণার্থীদের সংখ্যা মে মাসের মাঝামাঝি ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ভারতের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। প্রথম দিকে স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন, পরিত্যক্ত বাড়ি-আঙিনা, সরকারি স্থাপনা, হাটবাজারের চালা, খালি গুদামঘরে আশ্রয় দেওয়া হয়। তারপর ক্রমে বাঁশ আর উপরে ত্রিপল টেনে সারি সারি খুপরি। প্রতিদিন শুধু যশোর রোড দিয়েই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে ৩০ হাজারের মতো শরণার্থী। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এই শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি।

পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় ভারতের সীমান্তবর্তী প্রত্যেক এলাকাজুড়ে তখন শরণার্থী শিবির। ছোটো কুটিরের ছাউনি, ছোটো তাঁবু, সিমেন্টের শিট বা ড্রেইনের পাইপ, এই ছিল শিবিরগুলোয় শরণার্থীদের ঘর।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’তে জুলিয়ান ফ্রান্সিস শরণার্থী শিবির ঘুরে লিখেছিলেন, ‘অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে পরিবারগুলো ভিজে জবুথবু, তাদের মাঝে কাপড় শুকানোর দড়ি ছাড়া দু’টি পরিবারকে আলাদা করার মতো কোনো দেয়াল নেই। খড়ের তৈরি ছাউনি বৃষ্টির কাছে অসহায়, মাটির বিছানা ভিজে একাকার। প্রতিনিয়ত কুটিরগুলো থেকে শত শত শরণার্থী সরকারি রেশনের জন্য লাইন ধরছে, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য তাদের সারিও চোখে পড়ার মতো। অনেক শরণার্থী শিবির ছিল নিচু এলাকায়। বর্ষাকালে একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি জমেছে। বর্ষার দিনে পানির মধ্যে সারারাত দাঁড়িয়েই কেটেছে মানুষগুলোর। তারপর হয়েছে নিউমোনিয়া। কিন্তু এত অগণিত অসুস্থ-অভুক্ত রোগীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার বা ওষুধপত্র। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে অসংখ্য শরণার্থী। ক্যাম্পগুলোতে আরো ছিল খাবার পানির অভাব। পানিশূণ্যতায় ভুগেছে অজ¯্র লোক! খাবারেরর অভাব এতটাই প্রকট ছিল যে, শিশুদের বুকের পাঁজরের হাড় পর্যন্ত গোনা যেত। কেবল অপুষ্টিতে ভুগে মারা গিয়েছিল কয়েক লক্ষ শিশু।

পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যত শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অবস্থান করছিল পশ্চিমবঙ্গে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৭৫ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীদের চাপ সামলানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছু শরণার্থী ভারতের অন্য জায়গায় স্থানান্তর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। এছাড়া ত্রিপুরায় ১৪ লাখের বেশি, মেঘালয়ে প্রায় ৭ লাখ এবং আসামে তিন লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। সবমিলিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।

মে মাসে বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের চাপে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর জনমিতি বদলে গেছে।

তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের শরণার্থীরা যে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্য খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির জোগাড় করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ করা হতোÑ ৩০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম আটা, ১০০ গ্রাম ডাল, ২৫ গ্রাম ভোজ্য তেল এবং ২৫ গ্রাম চিনি।

এর মধ্যে প্রতিদিনই লম্বা হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশি শরণার্থী জুন-জুলাই মাসের কলেরার মতো মহামারিসহ অন্যান্য রোগব্যাধিতে মারা গেছে। এই সংখ্যার মধ্যে এপ্রিল-মে মাসে শরণার্থীদের পথযাত্রায় এবং ক্লান্তি ও পুষ্টি এবং অন্যান্য ব্যাধিতে মৃত্যুসংখ্যা হিসাব করা হয়নি। সব সংখ্যা হিসাব করা হলে শরণার্থী শিবিরে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আরো কয়েক লাখ বেশি হতে পারে বলে আমরা অনুমান করি। তৎকালীন ভারত সরকার এবং আন্তর্জাতিক নানা দেশ এবং সংস্থার সর্বাত্মক সহায়তা সত্ত্বেও একাত্তরের যুদ্ধের পরিণতিতে দেশ ত্যাগ করা কোটি মানুষের জীবনে যে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে এই অগণিত মৃত্যু রোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিনই বহু শরণার্থী স্বাধীন বাংলাদেশের দিকে ছুটতে থাকে। ভারত সরকার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই ফাঁকা হতে থাকে শরণার্থী শিবিরগুলো।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ভারতের সংবাদসংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানায় এখনো পর্যন্ত ৩০ লাখ শরণার্থী তাদের দেশে ফিরে গেছে।

ভারতের পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া জানায়, প্রতিদিন দুই লাখের বেশি শরণার্থী ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে এক লাখের বেশি।

শরণার্থীদের সর্বশেষ দলটি বাংলাদেশে ফিরে আসে ২৫ মার্চ ১৯৭২-এ। এই দলে ছিল প্রায় চার হাজার শরণার্থী। তারা ফিরে আসার পরে ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গ্রন্থনা : ফাতেমা ইয়াসমিন