কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ছবি ও ভিডিও চিনবেন যেভাবে

21 Nov 2023, 03:36 PM প্রযুক্তি শেয়ার:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ছবি ও  ভিডিও চিনবেন যেভাবে

বিপ্লবের তিনটি পর্ব পার করে আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে বিগ ডাটা, থ্রিডি প্রিন্টিং, আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিক্স, ড্রোন, সেন্সর প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং, অগমেন্টেড রিয়ালিটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ব্লকচেইন ইত্যাদি অন্যতম। প্রযুক্তির সুবিধার অপব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ. আই ব্যবহার করে তৈরি করা, ছবি ও ভিডিও নিয়ে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর প্রচার নিয়ে এই প্রতিবেদন


কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ছবি যাচাই

সাধারণ তোলা ছবি এবং এ. আই. জেনারেটেড ছবির মধ্যে দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য দেখা যায়। তাই ছবি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সেটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এজন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব ছবি সম্পর্কে সন্দেহ করতে হবে। আবার এআই জেনারেটেড ছবি সন্দেহ হওয়া সব ছবি-ই যে এ. আই. জেনারেটেড হবে তা-ও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। স্কেচ কিংবা আর্ট কিংবা ডিজিটাল আর্টসহ সমজাতীয় অনেক ধরনের কন্টেন্ট হতে পারে। তাই সে বিষয়টিও নিশ্চিত হতে চেষ্টা করতে হবে।

ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এই ছবি সম্পর্কে কোনো তথ্য আগে থেকেই ইন্টারনেটে রয়েছে কি না সেটা দেখতে হবে।


প্রথম পোস্টকারীর কাছ থেকে ছবি সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়া : কোনো ছবি এ. আই. জেনারেটেড বলে সন্দেহ হলে সেই ক্যাপশনসহ সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সকল ক্যাপশন বা কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে অথবা রিভার্স সার্চ করে কিংবা যেকোনো উপায়ে ছবিগুলো প্রথম কে কোন মাধ্যমে আপলোড করেছে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে। এরপরে সেই আপলোডকারীর কাছ থেকে ছবির ব্যাপারে তথ্য জানতে চাইতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সবসময়ই যে তিনি রেসপন্স করবেন এমন নিশ্চিত করা যায় না।

এ. আই. প্রোগ্রাম দিয়ে ছবি জেনারেট করে এমন প্ল্যাটফর্মগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও হ্যান্ডেলগুলোতে আলোচিত ছবি সম্পর্কে খোঁজ করা যেতে পারে। যদিও অধিকাংশ প্ল্যাটফর্ম এখনও তাদের জেনারেটেড কন্টেন্ট কোথাও আপলোড বা সংরক্ষণ করা শুরু করেনি।

প্রাপ্ত ছবিটি দেখে ছবির কন্টেক্সট দেখে যথাসম্ভব সঠিক ইনপুট কি-ওয়ার্ড বা নির্দেশনা তৈরি করে সেই নির্দেশনা বিভিন্ন এ. আই. ইমেজ জেনারেটরে ইনপুট দিয়ে দেখতে হবে। যদি হুবহু এক কিংবা প্রায় একই ধরনের ছবি আউটপুট হিসেবে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে আলোচিত ছবিটিকে এ. আই. জেনারেটেড ছবি হিসেবে ধরা যেতে পারে।

সন্দেহজনক কোনো ছবিতে যদি কোনো স্থান সম্পর্কে নতুন কোনো ধারণা কিংবা ঘটনা কিংবা বিষয়ের ইঙ্গিত বহন করে কিন্তু ইন্টারনেটে কিংবা সংবাদমাধ্যমে সেই স্থানের বাস্তবিক চিত্র সেরকম না পাওয়া যায় বা সে ঘটনা সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সেগুলোও এ. আই. জেনারেটেড ছবি হতে পারে। এছাড়াও, একটি স্থানে এমন এক ঘটনার কথা বলা হলো [ছবিতে] যেখানে সেই ঘটনা ঘটা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয় তাহলে তা-ও এ. আই. জেনারেটেড ছবি হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় কোনো স্থাপনা বরফে ঢেকে গেছে এমন ছবি যদি পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সেটি সম্পর্কে সন্দেহ করা যায়। কেননা, সাধারণত বাংলাদেশে বরফ পড়ে না, আবার যদি সেরকম কিছু ঘটে থাকতো তাহলে অবশ্যই গণমাধ্যমে সে বিষয়ে তথ্য থাকতো।

অনেক সময় স্কেচ বা বিভিন্ন আঁকা ছবিকে প্রযুক্তির সহায়তায় জীবন্ত করা হয় সেগুলো সরাসরি এ. আই. জেনারেটেড না হলেও প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পাদিত ছবি হিসেবে ধরে নিতে হবে। এগুলো শনাক্ত করার ক্ষেত্রে স্কেচ রিলেটেড ক্যাপশনসহ বিভিন্ন উপায়ে সার্চ করে খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। অনুসন্ধানে কোথাও কোনো নাম বা সূত্র পেলে সেই সূত্রের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে।

কমেন্ট বক্সে সূত্র বা প্রমাণ সম্পর্কে খোঁজ করা : অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এজাতীয় ছবির ক্ষেত্রে ছবি যিনি তৈরি করেছেন তিনি নিজেই সত্যতার বিষয়ে মতামত প্রদান করেন। অথবা যিনি সত্যতা সম্পর্কে জানেন এমন কেউ মতামত দিতে পারেন।

প্লাটফর্মগুলোতে যুক্ত হয়ে জেনারেটেড ছবির সংগ্রহ আছে কি না সেটা যাচাই করা। সংগ্রহ বা ডাটাবেজ থাকলে সেখানে খোঁজার চেষ্টা করা। যেমন মিডজার্নি নামক ছবি জেনারেটর একটি এ. আই. টুলসের ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার পরে সবার ইনপুট থেকে তৈরি করা ছবিগুলো দেখা যায় [ডিস্কর্ডে]।

ছবিতে ওয়াটারমার্ক খোঁজা : কিছু এ. আই. প্ল্যাটফর্ম তাদের দ্বারা তৈরি ছবিতে ওয়াটারমার্ক যুক্ত করে দেয়। আবার অনেক সময় যিনি ইনপুটের মাধ্যমে তৈরি করেন তিনি নিজেও ওয়াটারমার্ক সংযুক্ত করে প্রচার করেন। সেক্ষেত্রে এসব এ. আই. জেনারেটেড ছবিতে ওয়াটারমার্ক পাওয়া যায়। সেই ওয়াটারমার্ক-এর সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ. আই. জেনারেটেড ছবিতে বড়ো ও কাছের বিষয়বস্তু স্পষ্ট ও নিখুঁত হলেও ছবির মধ্যে থাকা ছোটো ও দূরবর্তী বিষয়বস্তু নিখুঁত ও স্পষ্ট হয় না, ঝাপসা থেকে যায়। এরকম নানাবিধ অসংগতি খোঁজ করা যেতে পারে।

এ. আই.-এর পাশপাশি হুবহু জীবন্ত কোনো মানুষ কিংবা প্রাণীর ছবি তৈরির একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। একে বলা হয় এবহবৎধঃরাব অফাবৎংধৎরধষ ঘবঃড়িৎশ বা এঅঘ কন্টেন্ট। এই পদ্ধতিতে প্রধানত হুবহু জীবন্ত মানুষ, বিড়াল, ঘোড়া, আর্টওয়ার্ক, শহর বা এজাতীয় কিছু তৈরি করা হয়। এঅঘ কন্টেন্ট যাচাই করা আরো বেশি কঠিন ও দুরূহ। তবে, সময়ের পরিক্রমায় এসকল কন্টেন্ট যাচাই করার জন্যও প্রযুক্তিগত উন্নতি হচ্ছে। এঅঘ কন্টেন্ট যাচাইয়ের এরকম একটি সাইট লিংক পাবেন এখানে। এছাড়াও ইন্টারনেটে এজাতীয় আরো কিছু টুলস পাওয়া যায়। নিশ্চিত কোনো সমাধান না পেলেও এখান থকে অনুসন্ধানে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।


কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ভিডিও যাচাই

মেশিন প্রোগ্রাম বা এ. আই. প্রোগ্রাম-এ নির্দেশনা ইনপুট দিয়ে তৈরি করা ভিডিওকে এ. আই. জেনারেটেড ভিডিও বলে। এমনকি ডিপফেক ভিডিও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে, ডিপফেক ভিডিওতে প্রধানত তারকা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির অনুরূপ হিসেবে নকল ভিডিও তৈরি করা হয়ে থাকে। সে কারণে ডিপফেক ভিডিও যাচাই করার প্রক্রিয়াগুলো সাধারণ এআই জেনারেটেড ভিডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করার উপায়ও আবিষ্কার হয়েছে। খালি চোখে সাধারণ মানের ডিপফেক ভিডিওগুলো শনাক্ত করা এখনও সম্ভব হতে পারে। অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি, চোখের পাতার অস্বাভাবিক নড়াচড়া কিংবা মাথার অস্বাভাবিক গতিবিধি বা নড়াচড়া, অবাস্তব ত্বকের রং বা ত্বকের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ; ঝাঁকুনি, ঠোঁট নড়াচড়ার সঙ্গে কথার কম মিল, ব্যাকগ্রাউন্ডের চেয়ে ব্যক্তির মুখ অস্পষ্ট, সাবজেক্টে আলো সমস্যা, ফ্রেমে অতিরিক্ত পিক্সেল ইত্যাদি [তথা ক্রিটিকাল থিংকিং বা যুক্তিনির্ভর চিন্তাশীলতা] দেখে প্রাথমিকভাবে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রেই ডিপফেক ভিডিও যাচাই করা যায়। সবার ব্যবহারের জন্য সরাসরি উন্মুক্ত টুলসের ব্যাপারে না জানা গেলেও কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কিছু টুলস রয়েছে যার দ্বারা ডিপফেক শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও শনাক্তের জন্য নতুন নতুন টুলস তৈরির জন্য গবেষণা ও চেষ্টা চলছে।

যদিও অডিও ম্যানিপুলেশন, অর্থ্যাৎ শব্দ নিয়ে কারসাজির ব্যাপারেও আলোচনা হচ্ছে তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডিপফেক ভিডিও ফরম্যাটে হয়। তাই ডিপফেক যাচাই করার ক্ষেত্রে ভিডিও থেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বা বিভিন্ন সময়ের ছবি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ টুলস ব্যবহার করে যাচাই করা যেতে পারে। ছবির ক্ষেত্রে ফটো মেটাডেটা কিংবা ভিডিও মেটাডেটা টুলস ব্যবহার করা হয়। সাধারণ ভিডিওর ক্ষেত্রে ইনভিড [রহঠরফ] ও ইউটিউব ভিডিওর ক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ‘ইউটিউব ডেটা ভিউয়ার’ ব্যবহার করা যেতে পারে।

জার্মানির মিউনিখের ভিজ্যুয়াল কম্পিউটিং ল্যাবের একটি দল তৈরি করেছে ফেস ফরেনসিকস্ টুলস। প্রোগ্রামটি র’-ফরমেট [যে ফরমেটে ধারণ করা] ফাইল থেকে ভিডিওর বিকৃতি সনাক্ত করতে পারে। তবে, ওয়েবের জন্য সংকুচিত বা কমপ্রেস করা ভিডিওর বেলায় তারা ফলাফল যাচাই করতে সফল হয়নি।

প্রযুক্তি যত উন্নত হয়ে উঠছে এবং ডিপফেক প্রযুক্তিও বা এঅঘ প্রক্রিয়াগুলো আরো উন্নত হয়ে উঠেছে। অদূর ভবিষ্যতে একটি ভিডিও এলো কি না তা বলা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

এ কারণেই ডিপফেকের বিরুদ্ধে এ. আই.-ভিত্তিক পাল্টা ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ চলছে। কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশ অব্যাহত থাকায়, এই পাল্টা ব্যবস্থাগুলোকে গতিশীল রাখতে হবে। সম্প্রতি, ফেসবুক এবং মাইক্রোসফ্ট, অন্যান্য কোম্পানি এবং বিশিষ্ট ইউএস ইউনিভার্সিটিগুলির একটি গুচ্ছের সঙ্গে ডিপফেক ডিটেকশন চ্যালেঞ্জ [উঋউঈ]-এর পিছনে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে। এই উদ্যোগটি গবেষকদের একটি ভিডিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পরিবর্তন করা হয়েছে কি না তা শনাক্ত করতে পারে এমন প্রযুক্তি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে।

এছাড়াও, বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করেও ডিপফেক শনাক্ত করা সম্ভব। বায়োমেট্রিক্স হলো আমাদের শরীরের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। একজন মানুষের বায়োমেট্রিক্স জানলে সেই ব্যক্তিকে সনাক্ত করা সম্ভব। ডিপফেক উন্মোচন করার জন্য বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার দুটি প্রক্রিয়ায় হতে পারে, প্রথমত আচরণগত বায়োমেট্রিক্স এবং অন্যটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি বা ফেসিয়াল রিকগনিশন।

ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে যেসকল বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে সাধারণ এ. আই. জেনারেটেড ভিডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও ভিডিওর বিষয়বস্তু সম্পর্কে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। এছাড়াও ভিডিওটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে ভিডিওর বিভিন্ন দৃশ্য থেকে স্ক্রিনশট বা ছবি নিয়ে সেই ছবি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এই ছবি তথা ভিডিও সম্পর্কে কোনো তথ্য আগে থেকেই ইন্টারনেটে রয়েছে কি না সেটা দেখতে হবে। হ

আনন্দভুবন ডেস্ক