চতুর এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন দিনে রাতে যেকোনো সময় হুল ফুটোতে পারে -ড. কবিরুল বাশার

23 Jul 2023, 02:28 PM অন্যান্য শেয়ার:
চতুর এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন  দিনে রাতে যেকোনো সময় হুল ফুটোতে পারে  -ড. কবিরুল বাশার

ডেঙ্গু হলো একটি মশাবাহিত ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত একটি জ্বর রোগ যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রায় সব দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির স্ত্রী মশা দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় এডিস অ্যালবোপিকটাসের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। এই প্রজাতির মশা চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার এবং জিকা ভাইরাসেরও বাহক।

পৃথিবীতে প্রতিবছর ৩৯০ মিলিয়ন ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ হয়, যার মধ্যে ৯৬ মিলিয়ন ক্লিনিকালি তীব্রতাসহ প্রকাশ পায়। পৃথিবীর ১২৯টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও এর ৭০ ভাগ এশিয়ায়। বাংলাদেশে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ডেঙ্গু হলেও তখন এই রোগটিকে বলা হতো ‘ঢাকা ফিভার’। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম চিহ্নিত করা হয় যে, এই রোগটি ডেঙ্গু। বাংলাদেশে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে তবে এ বছর আক্রান্ত এবং মৃত্যু সংখ্যা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে এসেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

ডেঙ্গু ফ্লাভিভিরিডি পরিবারের একটি ভাইরাস এবং এর চারটি স্বতন্ত্র, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেরোটাইপ রয়েছে [উঊঘঠ-১, উঊঘঠ-২, উঊঘঠ-৩ এবং উঊঘঠ-৪] যা ডেঙ্গু সৃষ্টি করে। একটি সেরোটাইপ দিয়ে একবার ডেঙ্গু হলে একই সেরোটাইপ দিয়ে আর ডেঙ্গু হয় না। তবে অন্য সেরোটাইপ দিয়ে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে যা মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে।

ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ার কারণে এই রোগটির তেমন নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। আবার ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং এই কারণে যে, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপই ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়। তবে কোনোভাবেই যেন মশার সাথে পেরে উঠছে না মানুষ।

পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ১২৩ প্রজাতির মশা। মশা ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ক্ষুদ্র এ প্রাণীটি যেকোনো পরিবর্তিত ও প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে পরিবর্তন করে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর সেটি যদি ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

সিঙ্গাপুরের মতো পৃথিবীর অনেক পরিচ্ছন্ন শহরেও এডিস ইজিপ্টি দুর্দান্ত শক্তি নিয়ে তার অবস্থান শক্ত করে সফলভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাস তিনেক আগে চাইনিজ নিউজ এজেন্সি বেইজিং নিউজ আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল। সেখানে সারাপৃথিবীতে ডেঙ্গু রোগ বিস্তার এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। সঞ্চালক একসময় আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করল সিঙ্গাপুরের মতো এত পরিচ্ছন্ন শহরেও ডেঙ্গু কেন হচ্ছে ? সেখানে তো মানুষ শিক্ষিত এবং অনেক সচেতন। তারপরেও তারা কেন ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ? তার এই প্রশ্নটির সূত্র ধরে আমি বিগত তিনমাস পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজ শুরু করি। তিন মাসের ল্যাবরেটরি এবং মাঠপর্যায়ের গবেষণায় আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য পাই।

আমরা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে পরিষ্কার পানির কথা জানি। আমি নিজেও এটি সবসময় বলে এসেছি। কিন্তু আমাদের গবেষণায় আমরা পেয়েছি এডিস মশা সুয়ারেজের পানি, ড্রেনের পানি এবং এমনকি সমুদ্রের নোনা পানিতেও ডিম পাড়ে এবং তার জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। এক সেন্টিমিটার পরিমাণ জমে থাকা পানিতেও আমরা এডিস মশার বংশবৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছি। শুকনো অবস্থায় এডিস মশার ডিম ৬-৯ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে এবং সামান্য পানির সংস্পর্শে এলে সেটি ফুটে লার্ভা তৈরি হয়। ইতোপূর্বে আমরা জানতাম এডিস মশা শুধু দিনেরবেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং বিকেলে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি এবং মাঠপর্যায়ের গবেষণায় আমরা পেয়েছি এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। তবে রাতেরবেলায় কামড়ানোর হার কম। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং মানুষের আচরণের কারণে এই মশা অত্যন্ত সুচতুরভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করে নিয়েছে।

প্রকৃতিতে এডিস মশার ঘনত্ব যেহেতু খুব বেশি নয় আর আমরা এটাও জানি না কোন এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে কোনটি নয়। তাই আমাদেরকে রাতে বা দিনে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোভাবেই এডিস মশা কামড়াতে না পারে।

এডিস মশার প্রজনন আচরণ এবং রক্ত খাওয়ার সময় পরিবর্তন একজন গবেষক হিসেবে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তার এই সুচতুর আচরণ প্রমাণ করে যে, মানুষ তার বিরুদ্ধে যতই পদক্ষেপ নিক না কেন, সে নিজের পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে বেঁচে থাকবে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বাসা-বাড়ির ধরন পরিবর্তন হয়েছে। মশার প্রজনন হয় এরকম ছোটো-বড়ো ৫২ ধরনের প্রজনন পাত্র চিহ্নিত করেছে আমাদের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা দল। এর মধ্যে এমন কিছু প্রজননস্থল আছে, যেগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণ বেশ কষ্টসাধ্য। বেশিরভাগ শহরে বড়ো বড়ো অট্টালিকা তৈরি হয়েছে আর এই অট্টালিকার বেসমেন্টে গাড়ি রাখা এবং গাড়ি ধোয়ার জায়গা করা হয়েছে। গাড়ির পার্কিংয়ে জমে থাকা সামান্য পানিতেও আমরা এডিস মশার প্রজনন হতে দেখেছি। বড়ো বড়ো ভবনের মেইন গেটের ছোট্ট চ্যানেলের মধ্যেও আমরা এডিস মশার লার্ভা পাচ্ছি। এজাতীয় ছোটো-বড়ো প্রজননস্থলগুলো মশা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। এছাড়াও বাংলাদেশের যেসব জায়গায় মেগা কনস্ট্রাকশন চলছে সেসব জায়গায়ও এডিস মশার প্রজননের জন্য অন্যতম একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়া তার অন্যতম উদাহরণ।

মশার এই আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মশা সুপার পতঙ্গে পরিণত হচ্ছে। তাই মশার আচরণ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। মশার পরিবর্তিত আচরণ জেনে আমরা যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং তার প্রয়োগ করতে পারি তখনই এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।

আর এই মশাকে শাসনে এনে রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সারাদেশে মশা বা পতঙ্গবাহিত রোগে নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাহক বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি এবং ভারতের ভিসিআরসি-এর কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের জন্য ভেক্টর কন্ট্রোল সেল নামে এমন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা আমি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দেই দিয়েছিলাম। সেটির বাস্তবায়ন বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রক্রিয়াধীন আছে বলে আমি শুনেছি। এই প্রতিষ্ঠানটি বাহক বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে মশা এবং অন্যান্য বাহকের আচরণ ও অভিযোজন বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা করবে। তদুপরি এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক, যন্ত্রপাতি এবং এর রোগতত্ত্ব নিয়ে সারাবছর গবেষণা করবে এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে [ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন] প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবে। বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে বাহক বাহিত রোগ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি নিয়ন্ত্রণে তারা পদক্ষেপ নেবে।

শুধু প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেই হবে না। এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দিতে হবে অত্যন্ত অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের হাতে। প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব নিবেদিত অভিজ্ঞ মানুষের কাছে না দিলে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক

প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়